অভীক পুরকাইত,কলকাতা:– অভীক পুরকাইত,কলকাতাঃ– ছাত্ররা প্রাপ্তবয়স্ক, তাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা তারা মদ্যপান করে, যাদের ইচ্ছা নয় তারা করে না, কেউ কেউ লুকিয়ে ক্যাম্পাসের কোণে বসেও করে থাকতে পারে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় সবাই বিষণ্ণ, মর্মাহত। মর্মান্তিক ঘটনাটি নিয়ে হতবাক অবস্থা কাটলে প্রথমেই যে অনিবার্য কথাটা বলতে হয় তা হল, এই ঘটনার যথাযথ বিচার হোক, দোষীদের আইনানুগ শাস্তি হোক। তার পরের কথাটা এই, যাদবপুর-সহ আরও বহু ক্যাম্পাস থেকে র্যাগিংকে কী করে নির্মূল করা যায়? যাদবপুরের ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব প্রাথমিক ভাবে কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে, দায়িত্ব বর্তাবে ছাত্র ও শিক্ষকদের উপরেও। র্যাগিংকে একটা অপরাধ বলে মনেপ্রাণে মানতে হবে। এত দিন ধরে যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিং চলেছে তার একটা কারণ, এর প্রচ্ছন্ন সমর্থনে অনেকে কুযুক্তি খাড়া করেন— ওটা নতুন ছাত্রদের সঙ্গে পুরনোদের পরিচয়ের একটা উপায় ইত্যাদি। এ সম্পূর্ণ ভুল কথা। র্যাগিং বন্ধে সমাজে সচেতনতা চাই, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কড়া মনোভাব চাই, শুধু মুখের কথায় নয়, কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে।এই অবধিই বলার কথা ছিল, এবং এ ব্যাপারে অপারগতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যথোচিত নিন্দাও স্বাভাবিক। যাদবপুরের সাধারণ সংস্কৃতি নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলিও নিশ্চয় বিচার করে দেখা উচিত। একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাণবন্ত থাকার জন্য নিয়মিত আত্মসমীক্ষা প্রয়োজন। কিন্তু এর পর আলোচনা অন্য দিকে মোড় নিয়েছে। দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি এই ঘটনাসূত্রে যাদবপুরকে ধ্বংস করার পুরনো মতলব সিদ্ধিতে নেমে পড়েছে। তাদের সমর্থকদের দাবি, যাদবপুরে একটা বামপন্থী সংস্কৃতি আছে, সে কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে। যাদবপুর নাকি উচ্ছৃঙ্খলতার একটা পীঠস্থান, তাই এই ঘটনা ঘটেছে।মিথ্যা, অর্ধসত্য বলে লোক খেপানো, গুলিয়ে দেওয়া এবং ঘোলা জলে মাছ ধরাটা দক্ষিণপন্থীদের পুরনো অস্ত্র। যাঁরা যাদবপুরকে এদের হাত থেকে বাঁচাতে চান, প্রকৃত চিত্র তুলে ধরাটা তাঁদের দায়িত্ব। বাম, বামবিরোধী, অতিবাম, বিভিন্ন মানসিকতার সহাবস্থান থাকলেও যাদবপুরে একটা আধুনিক প্রগতিশীল মুক্তমনের চর্চা আছে, যার ফলে দক্ষিণপন্থী ও রক্ষণশীল ভাবনাচিন্তা সেখানে কখনও সুবিধা করে উঠতে পারেনি। সেই হতাশা থেকেই তারা এ বার যাদবপুরকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে নেমেছে। তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আগাগোড়া একটি অতি উচ্ছৃঙ্খল জায়গা, সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা সকালে ক্যাম্পাসে ঢুকেই নানা উচ্ছৃঙ্খলতায় মেতে ওঠে। এই অভিযোগ যে কত হাস্যকর তার প্রমাণ: অপ্রতুল সরকারি সাহায্য সত্ত্বেও, ছাত্রদের থেকে প্রায় কোনও বেতন না নিয়েও, সম্পূর্ণ নিজের কৃতিত্বে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বছরের পর বছর ধরে ভারতের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে জায়গা করে নিচ্ছে।যাদবপুর এমন এক বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে শুধুমাত্র মেধার পরিচয়ে অসংখ্য প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে। শুধু পড়াশোনা নয়, একটি প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে যা-যা হওয়ার কথা— সারা বিশ্বের ভাবনাচিন্তা, জ্ঞানচর্চা, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা— সবই হয় এখানে। কখনও ছাত্রদের আয়োজিত চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয় বিশ্বখ্যাত সব ছবি, শোনার সুযোগ হয় অমর্ত্য সেন-ইরফান হাবিবের বক্তৃতা, কখনও বা ভারতসেরা সঙ্গীতশিল্পীদের গানবাজনা। যুক্তি ও সামাজিক ন্যায়ের চর্চাও যাদবপুরের বৌদ্ধিক জগতের একটা প্রধান অংশ, এখানকার ছাত্র-শিক্ষকদের সংস্কৃতিতে জাতি ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ, পারিবারিক-সামাজিক পৃষ্ঠভূমি ইত্যাদির ভিত্তিতে সচরাচর বৈষম্য করা হয় না,
ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বার বার এই সব বৈষম্যের ভিত্তিতে নানা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটলেও যাদবপুরে তা শোনা যায় না। শিক্ষাও যখন বহুলাংশে পণ্যায়িত, বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তো বটেই, এমনকি আইআইটি-র মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানেও উচ্চশিক্ষা পেতে লক্ষ লক্ষ টাকা লাগে, তার বিপরীতে যাদবপুর যেন এক ম্যাজিক, যেখানে প্রায় বিনা পয়সায় সেরা শিক্ষা পাওয়া যায়। যেমন পাওয়া উচিত, যে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়।
কিন্তু কর্পোরেট শিক্ষা ব্যবসায়ী ও তাদের সহযোগী রাজনৈতিক শক্তির তা পছন্দ নয়। তদুপরি এখানে রয়েছে যুক্তিবাদের, মানবিক সংস্কৃতির চর্চা। তাই যাদবপুরের উপর আক্রমণ। দীর্ঘ দিন ধরে সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ কমানো বা আটকে রাখা হয়েছে, পড়ে আছে অনেক শূন্য পদ। মর্মান্তিক ঘটনাটির সময় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উপাচার্যহীন। বস্তুত যাদবপুর যে বছরের পর বছর দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে নিজের জায়গা ধরে রেখেছে, তার অনেকটাই তার নিজস্ব চেষ্টায়, শিক্ষক-ছাত্র-প্রাক্তনীদের প্রয়াসে, বিভিন্ন প্রকল্পে উৎকর্ষের প্রমাণ দেখিয়ে।
ছাত্ররা প্রাপ্তবয়স্ক, তাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা তারা মদ্যপান করে, যাদের ইচ্ছা নয় তারা করে না, কেউ কেউ লুকিয়ে ক্যাম্পাসের কোণে বসেও করে থাকতে পারে। পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রদের মদ্যপান আলোচ্য বিষয় নয়, তা দিয়ে কেউ।
কেউ লুকিয়ে ক্যাম্পাসের কোণে বসেও করে থাকতে পারে। পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রদের মদ্যপান আলোচ্য বিষয় নয়, তা দিয়ে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষ বিচার করে না। এগুলো যাদবপুরের আসল পরিচয় নয়। আজ যারা যাদবপুরকে ধ্বংসের ইচ্ছা নিয়ে নেমেছে, রাষ্ট্র বা ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে লোককে ভুল বোঝানো, ভয় দেখানো; প্রশ্নহীন আনুগত্যের মাধ্যমে দমিয়ে রাখাই তাদের কারবার। এদের হাত থেকে যাদবপুরকে বাঁচানোই একটা সুস্থ সমাজের দায়িত্ব।