দেবব্রত সেনগুপ্ত, কলকাতা : রবীন্দ্রনাথ নাম রেখেছিলেন অগ্নিকন্যা। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কথাটা শুনলেই মনটা রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। পলকে মাথায় খেলে যায় এক রোমহর্ষক যুদ্ধ, এক অসীম সাহসিকতা।এই অসীম সাহসী যুদ্ধে মাস্টারদা সূর্যসেনের দুই সহযোগী মহিলা যোদ্ধা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার আর কল্পনা দত্ত। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জুলাই অবিভক্ত বাংলায় চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলা -এর শ্রীপুর গ্রামের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্তের জন্ম । তাঁর পিতা বিনোদবিহারী দত্ত ও মা শোভনা বালা দত্ত। তাঁর ঠাকুরদা ডাক্তার দুর্গাদাস দত্ত চট্টগ্রামের একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক ছিলেন । ইংরেজ প্রশাসনের কাছে ডঃ দুর্গাদাস দত্তের একটা প্রভাব ছিল। ফলে তাঁদের বাড়ি ছিল পুলিশের নজরের বাইরে। শৈশব থেকেই কল্পনা দত্ত ছিলেন অন্য সমবয়স্কদের থেকে ভিন্ন মানসিকতার। তিনি ছিলেন অত্যন্ত আবেগপ্রবণ এবং দুঃখী মানুষের দুঃখ কষ্ট তাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যেত। অল্প বয়স থেকেই দেশের সাধারণ মানুষকে তাদের দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার কথা ভাবতেন তিনি। ১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতায় বেথুন কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন কল্পনা দত্ত। স্কুল জীবন থেকেই ক্ষুদিরাম ও কানাইলাল দত্ত-এর বিপ্লবী কর্মকান্ড স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানে তাঁকে আগ্রহী করে তুলেছিল। তিনি বেথুন কলেজে গড়ে ওঠা ছাত্রী সংঘ-এ সদস্য পদ গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের মাধ্যমে মাস্টারদা সূর্যসেন পরিচালিত বিপ্লবী গোষ্ঠীতে যোগদান করেন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ ঘটনার পর কল্পনা দত্ত চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। পূর্ণেন্দু দস্তিদার ১৯৩১ সালের মে মাসে তাঁকে সূর্যসেনের সাথে সাক্ষাৎ করান। সেই সময় অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অভিযোগে অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ ও লোকনাথ বল প্রমুখ বহু নেতা গ্রেপ্তার হয়ে বিচারাধীন ছিলেন। বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের বিচার ও শাস্তি বানচাল করে তাদের পালাতে সহায়তা করার জন্য তিনি কোর্ট এবং জেলে ডিনামাইট বিষ্ফোরণের পরিকল্পনা করেন। কলকাতা থেকে ফেরার সময় তিনি গোপনে কিছু বিষ্ফোরক নিয়ে আসেন, এছাড়াও গোপনে গান কটনও তৈরী করেছিলেন। সেগুলি পাঠানো হতো জেলের ভেতরে। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ডিনামাইট ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। কল্পনাকে সন্দেহ করে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের আদেশ দেয় তদানীন্তন ইংরেজ সরকার। চট্টগ্রাম কলেজে গিয়ে বিএসসি পড়ার অনুমতি দিলেও অন্যত্র যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। এই নিষেধাজ্ঞা তাঁকে থামিয়ে রাখতে পারেনি রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে তিনি গ্রামে চলে যেতেন এবং সূর্য সেন, নির্মল সেনের সঙ্গে দেখা করতেন। এই সময় মাঝেমধ্যেই মাস্টার দার সাথে তিনি গ্রামে ঘুরে গ্রামের মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং তাদের দুঃখ কষ্টের খবর নিতেন। একই সঙ্গে এই সময় চলত তার বন্দুকের প্রশিক্ষণ। সংগঠনের পক্ষ থেকে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের জন্য কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ওপর দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই আক্রমণের আগেই তিনি পুরুষের ছদ্মবেশে সহকর্মী নির্মল সেনের সঙ্গে মাস্টার দার কাছে দেখা করতে যাবার সময় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। দুই মাসের কারাবাসের পর প্রমাণের অভাবে তাঁকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। পুলিশ ১০৯ ধারায় ভবঘুরের অভিযোগে অভিযুক্ত করে। মাস্টারদা তাঁকে পুলিশের সন্দেহ দৃষ্টি এড়াতে আত্মগোপন করতে বলেন। এ সময় চট্টগ্রামকে মিলিটারি এরিয়া বলে ঘোষণা করা হয়। প্রতি গ্রামেই ছিল মিলিটারি । আত্মগোপনে থাকা অত্যন্ত কঠিন কাজ। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ফেব্রুয়ারী সমুদ্র তীরবর্তী গৈরালা গ্রামে ইংরেজ ফৌজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে তিনি মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারের সঙ্গে সমানভাবে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে মাস্টারদা ও ব্রজেন সেন পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও কল্পনা দত্তকে ধরতে পারেনি ইংরেজির পুলিশ। মাস তিনেক পর ১৯ মে গৈরালা গ্রামে আরো এক সশস্ত্র সংঘর্ষের পর কল্পনা দত্ত এবং তাঁর কয়েকজন সঙ্গী পুলিশের হাতে ধরা পরে যান।১৪ আগস্ট ‘‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সেকেন্ড সাপ্লিমেন্টারি কেস’’। শুরু হয় এবং সেখানে মাস্টারদা সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্ত তিন জনের বিরুদ্ধেই রাজদ্রোহ, ষড়যন্ত্র, বিস্ফোরক আইন, অস্ত্র আইন হত্যা প্রভৃতি অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। মাস্টারদা এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির সাজা হলেও মেয়ে বলে এবং বয়স কম বলেই কল্পনা দত্তকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা গেল না করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় এবং দ্বীপান্তরে পাঠানোর কথা হয়। তখন বহু প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় দ্বীপান্তর স্থগিত করে তাঁকে হিজলি জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অগ্নিকন্যা কল্পনার মুক্তির আবেদন জানিয়ে গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গান্ধীজী, এন্ডরুজও এবং অনেকেই কল্পনার মুক্তির জন্য ঐকান্তিক প্রচেষ্টা করেন। ১৯৩৯ সালের ১ মে ছাত্র আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করলে ইংরেজ সরকার বাধ্য হয়ে কল্পনা দত্তকে মুক্তি দেয়। পরবর্তী জীবনেও তিনি দেশের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন।১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে ৮ই ফেব্রুয়ারি ৮২ বছর বয়সে অকুতোভয় বিপ্লবী প্রাণ- কল্পনা দত্ত চির নিদ্রায় শায়িত হন।