দেবব্রত সেনগুপ্ত, কলকাতা : ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শিক্ষায় অসামান্য প্রতিভার কারণে হয়েছিলেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎ ,মানুষের কাছে ছিলেন দয়ার সাগর। আজ থেকে ২০৩ বছর আগে ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ সালে মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে পিতা ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় এবং মা ভগবতী দেবীর ঘর আলো করে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের মহানুভবতার কথা লিখে শেষ করা যাবে না। তবুও দু’বছর আগের করণা আবহে ভীষণ সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বিষয় উল্লেখ করি। করোনা আবহে পাড়ায় পাড়ায় দানছত্র দেখা গেছে। অনেকক্ষেত্রেই মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রয়োজনীয় খাদ্য ইত্যাদি গ্রহণ করেছেন। পরে বিভিন্ন লেখালেখিতে দেখা গেল একশ্রেণীর মানুষ, যারা নিম্ন মধ্যবিত্ত , তারা নিরন্ন থাকলেও লজ্জায় সেখান থেকে দান নিতে পারেননি। বিদ্যাসাগর যে অন্নছত্র খুলেছিলেন, সেখানে দুস্থ মানুষের খাদ্যের, বস্ত্র এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা করেছিলেন। তথাপি যারা সংকোচের কারণে সেখানে আসতে পারতেন না, তাদের গৃহে গোপনে অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করতেন তিনি। দয়ার অবতার বিদ্যাসাগরের সাহায্য করার মনোবৃত্তি সম্পর্কে অজস্র ঘটনা উল্লেখ আছে। বিশ্ব বিখ্যাত কবি থেকে শুরু করে, হতদরিদ্র দুর্বিপাক গ্রস্থ মানুষ তাঁর সহায়তা লাভ করে পরিত্রান পেয়েছেন। শিক্ষার প্রসার এবং সমাজ সংস্কার সম্পর্কে তাঁর অবদান যত বলা যায় ততই কম। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় এবং সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তিনিষ্ঠ এক অকুতোভয় লড়াই বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়নের একমাত্র কারণ। এক্ষেত্রে তাকে ভয়ঙ্কর বাধার সম্মুখীন হতে হয়। বিধবা বিবাহ বিষয় সমাজের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ ও তাঁর প্রধান বিরোধী ছিলেন।প্রবল বিরোধিতা করে গোরা পণ্ডিতেরা কয়েকখানি পুস্তিকা প্রচার করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন, কাশীনাথ তর্কালঙ্কার, রামতনু তর্ক সিদ্ধান্ত, গঙ্গাধর কবিরাজ, মহেশচন্দ্র চূড়ামণি, শ্রীরাম তর্কালঙ্কার, ঈশানচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ ,গোবিন্দ বিদ্যাভূষণ, জগদীশ্বর বিদ্যারত্ন ,রামদাস তর্ক সিদ্ধান্ত, নন্দকুমার কবিরত্ন, আনন্দ শিরোমণি, হারাধন কবিরাজ, রামদয়াল তর্করত্ন ইত্যাদি। কিন্তু বিদ্যাসাগর পরাজয় মেনে নেওয়ার মানুষ ছিলেন না। তাঁর মত দৃঢ়চেতা মানুষ সত্যিই বিরল। বিদ্যাসাগরের সম্পর্কে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন যে,- “আমাদের এই অবমানিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এমন অখণ্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল, আমরা বলিতে পারি না।” ইংরেজ ধর্মের গোঁড়ামিতে আঘাত দিতে একেবারেই প্রস্তুত নয় বুঝে, দিনরাত এক করে পরাশর সংহিতা থেকে বের করলেন প্রয়োজনীয় বিধি সম্বলিত শ্লোক।
“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ / পচস্বাপতসু নারীনাং পতিরন্যো বিধায়তে”
— পরাশর সংহিতা থেকে নেওয়া এই শ্লোকের অর্থ—
স্বামী নিখোঁজ বা মৃত্যুবরণ করলে কিংবা নপুংসক বা পতিত হলে স্ত্রী আবার বিয়ে করতে পারেন। এই শ্লোককে অস্ত্র করে। তিনি প্রমাণ করে দেন হিন্দু ধর্মে বহু পুরনো সময় থেকেই বিধবা বিবাহের প্রচলন অনুমোদিত ছিল।
এরপর আইন পাস হতে আর কোন বাধা রইলো না। বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের বিরুদ্ধে প্রবল লড়াই এর মাধ্যমে ১৮৫৫ সালের ছাব্বিশে জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়। দেশের কল্যাণে এত বড় লড়াই জিতলেও, বিদ্যাসাগরের শেষ জীবন ছিল যথেষ্ট কষ্টের। তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্ধ স্নেহের কারণে বিদ্যাসাগরের একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্রের যথোপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারেননি। শিক্ষার জন্য তাকে একবার কলকাতায় নিয়ে আসলেও সে গ্রামে ফিরে যায় ঠাকুরদার কাছে। এই পুত্রের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক খারাপ হতে হতে একদম তলানিতে পৌঁছে যায় এবং তিনি নারায়ন চন্দ্র কে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেন। শেষ জীবনে বিদ্যাসাগর অভিমানে সব সম্পর্ক ত্যাগ করে নিরালা বাসের অভিপ্রায় বর্তমান ঝাড়খণ্ডের কার্মাটাঁড়ে স্টেশনের কাছে পাঁচশো টাকায় স্থানীয় এক ইংরেজ মহিলার কাছ থেকে আমবাগান সমেত প্রায় ১৪ বিঘা জায়গা কেনেন এবং সেখানে বাড়ি বানিয়ে বসবাস শুরু করেন। এই অঞ্চলে মূলত সাঁওতাল সহজ সরল আদিবাসী মানুষের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বিদ্যাসাগর এই সাঁওতাল মানুষদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে ভুট্টা কিনে নিতেন। আবার কাজ শেষে সাঁওতালেরা বিকেলে ফেরার সময় তাঁর কাছে খাবার চাইতেন । তখন সকালে এই সাঁওতালদের থেকেই কিনে রাখা ভুট্টা তাদেরকেই খেতে দিতেন বিদ্যাসাগর। সাঁওতালদের সঙ্গে মিশে গিয়ে বিদ্যাসাগরও সেই ভুট্টা পুড়িয়ে খেতেন । মানব দরদী বিদ্যাসাগর এলাকার আদিবাসীদের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে তাঁদের কাছে জীবনদাতা হয়ে উঠেছিলেন । সে সময় কলেরা ছড়িয়ে পড়লে মেথরপল্লিতে তিনি নিজের হাতে কলেরা রোগীর শুশ্রূষা করতেন।প্রতি বছর পুজো উপলক্ষে বিদ্যাসাগর গরীব মানুষের জন্য নতুন পোশাক কিনতেন। শীতের সময় কার্মাটাঁড়ে হাড়-কাঁপানো ঠান্ডায় মোটা চাদর কিনে গরিব মানুষের মধ্যে বিতরণ করতেন। একদম শেষের দিকে বিদ্যাসাগর কে আবার কলকাতায় ফিরে আসতে হয়। অসুস্থ অবস্থায় তিনি তাঁর কলকাতার বাদুড়বাগানের বাসভবনে থাকতেন। সেখানে ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই, বাংলা ১২৯৮ সনের ১৩ শ্রাবণ, রাত্রি দুটো আঠারো মিনিটে বিদ্যাসাগর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রয়াণ কালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর ১০ মাস ৩ দিন